পহেলা বৈশাখ নববর্ষ রচনা – ১৫ পয়েন্ট

নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ রচনা ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ SSC JSC HSC. Pohela Boishakh composition for class 6 7 8 9 10 SSC HSC JSC. অনুরুপভাবে লিখা যায়ঃ পহেলা বৈশাখ, ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, সার্বজনীন উৎসব।

পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ, ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, সার্বজনীন উৎসব। পহেলা বৈশাখ নববর্ষ রচনা – ১৫ পয়েন্ট
পহেলা বৈশাখ নববর্ষ রচনা – ১৫ পয়েন্ট

ভূমিকা

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ হচ্ছে বছরের প্রথম দিন কে বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিসত্ত্বার ঐতিহ্যের একটি অনিবার্য অংশ হচ্ছে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ। যে কোনাে বছরের প্রথম দিনটি ‘নববর্ষ’ ও ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। তেমনি হচ্ছে বাঙালির ঐতিহ্যকে যে সকল উৎসব অনুষ্ঠান ধারণ করে আছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম বাংলা নববর্ষ অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ।

আমরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে আসে বাঙালি জাতির উৎসব পহেলা বৈশাখ আসে।

পৃথিবীর সর্বত্রই নববর্ষ একটি ‘ট্রাডিশন’ বা প্রচলিত সংস্কৃতিধারা। আদিকাল থেকে বাঙালি জাতি বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে পালন করে আসছে। নববর্ষ বাঙালির সহস্র বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। রাত্রির তপস্যা শেষে এই শুভদিনের উদার অভ্যুদয়ে মানুষের হৃদয়-উৎসারিত কলােচ্ছাসে ভরে যায় পৃথিবী। নতুন দিনের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা, প্রার্থনা দুঃখ জয়ের।

হে নূতন, এসাে তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পহেলা বৈশাখ / নববর্ষ / বাংলা সানের ইতিহাস

ইঙরেজি ১৫৮৫ খিস্টাব্দ এবং হিজরী ৯৬৩ থেকে বাঙলা সন বা সাল চালু হয়। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের মতে, মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী তাঁর আমির ফতেউল্লাহ সিরাজী সৌরসন এবং হিজরী সনের সাথে মিল রেখে বাংলা সনের প্রচলন করেন। সিংহাসনে আরোহনের খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সন বা সাল প্রবর্তন করে। সেই সাথে তিনি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা বারো মাসের নামকরণও করেন। বৈশাখ নামটি এসেছে বিশাখা নামক নক্ষত্রের সাথে সাদৃশ্য রেখে।

পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাংলা সনের প্রথম দিন। যা আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তারপর থেকে মােগলরা জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ পালন করত। এ দিনটি বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এই উৎসাব প্রথমে খাজনা আদায়ের হিসেবে উদযাপন শুরু হয়।

তাই বাংলা নববর্ষের ধারণা বহু প্রাচীন হলেও ১৯৬৭ সালের আগে নববর্ষ উদযাপনের রীতি তেমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শাসনামলে সর্বপ্রথম পহেলা বৈশাখে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। সর্বোপরি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও শোষণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সাল থেকে রমনার বটমূলে ছায়ানট আয়োজিত বর্ষবরণ উৎসবের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখ জাতীয় উৎসবের দিনে রূপ নেয়। এটি বাঙালির একটি সার্বজনীন লােকউৎসব। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হল নববর্ষ, অতীতের ভুল ত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় পালিত হয় নববর্ষ।

পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ বলার কারণ

বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। আর বাংলা বছরের প্রথম মাস হচ্ছে বৈশাখ। সেই থেকে বাংলা নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন অর্থৎ ১ বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ বলা হয়ে থাকে। আমাদের এই দেশে কৃষিভিত্তিক তাই সব আনন্দ উৎসবের নিবিড় যােগসূত্র রয়েছে ফসলের সঙ্গে। আমাদের পহেল বৈশাখ বা নববর্ষের সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বােনার আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্র মাসে ফসল বুনলে ফসলের ফলন ভালাে হয় না এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে বাংলার কৃষক সমাজ বৈশাখ মাসে ফসল বােনার সূচনা করে। তাছাড়া পহেলা বৈশাখে বাঙালিরা অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে নতুনের আহ্বানে সাড়া দেয়। নতুনকে গ্রহণ করার জন্য উদ্দীপ্ত হয়। তাই পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ বলা হয়ে থাকে।

সময়কাল

বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে দিয়ে দুটি করে বারােটি মাস আবর্তিত হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ বলে বরণ করে নেওয়া হয় এ দিনটিকে। নতুন সব জিনিসেরই আলাদা একটা বৈচিত্র্য আছে। পুরনাে বছরের অবসানে নববর্ষ আসে তারুণ্যের প্রদীপ্ত প্রদীপ হাতে নিয়ে। আমাদের জীবনে ঐতিহ্যপূর্ণ এই দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ধরা দেয়। বাঙালিরা নববর্ষকে বরণ করে অন্তরের গভীর অনুরাগ দিয়ে। পহেলা বৈশাখ আমাদের যাত্রা শুরু লগ্ন। আমাদের নববর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বােনার আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্রের অবসানে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে নবজাগরণের ঢেউ জাগে।

নববর্ষের আশ্বাস

নববর্ষের দিনটি প্রতিদিনের মতােই একটি সাধারণ দিন মাত্র। প্রতিদিনের মতাে এ দিনটিও যথানিয়মেই শুরু হয়। আলােক-প্লাবনে পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়। পাখি গান গায়। গাছে গাছে শিহরণ জাগে। কিন্তু তবু এ দিনটি অন্য দিনগুলাের চেয়ে স্বতন্ত্র বিশিষ্ট। প্রাত্যহিক তুচ্ছতার উর্ধ্বচারী। বর্ষ-প্রদক্ষিণের পথে এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যে মহিমাভাস্বর। এ দিনটি আমাদের কাছে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। মুক্তি প্রাত্যহিকতার জীর্ণ জীবন থেকে, মুক্তি প্রতিদিনের ক্ষুদ্র, আত্মসর্বস্ব জীবনের গণ্ডি থেকে। মুক্তি চিত্তের, দীনতা ও হতাশা থেকে। প্রতিদিনের জীবনে আমরা ক্ষুদ্র। নববর্ষের পুণ্য – প্রভাতে আমরা মহৎ। এ দিন আমাদের কাছে পরম আশ্বাসের, পরম প্রার্থনার। 

বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপনের বৈশিষ্ট্র্য

পহেলা বৈশাখ বাংলার জনসমষ্টি অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে গিয়ে নতুনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওঠে। জানে এ নতুন অনিশ্চিতের সুনিশ্চিত সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ। তাই মন সাড়া দেয়, চঞ্চল হয়। নতুনকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নেয়।

রমনা বটমূল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের দৃশ্য  ছবিঃ ইন্টারনেট।
রমনা বটমূল পহেলা বৈশাখ উদযাপন ছবিঃ ইন্টারনেট
আর সে দিন প্রাত্যহিক কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে। রমনার বটের তলায় জড়াে হয়ে গান গায়, হাততালি দেয়। সবকিছু মিলে দেশটা যেন হয়ে ওঠে উৎসবে আনন্দে পরিপূর্ণ। এছাড়াও এদেশের স্থানীয় কতকগুলাে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষের বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে ওঠে। যেমন : মেঘের কাছে জল ভিক্ষা করা’, ‘বার্ষিক মেলা’, ‘পুণ্যাহ’, ‘হালখাতা‘ ইত্যাদি।

রাজধানীতে নববর্ষ উদযাপন

নববর্ষের উৎসবের সাথে যদিও আবহমান গ্রামবাংলার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তবে বর্তমানে গ্রামের গন্ডি পেরিয়ে বর্ষবরণ উৎসবের আবেদন শহরগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবছর “এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো” গানের মাধ্যমে রাজধানীর বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়। উৎসবের মূল আয়োজক ছায়ানট পহেলা বৈশাখ ভোরে এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। রাজধানীর বর্ষবরণ উৎসবের অন্যতম অনিবার্য অংশ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। মঙ্গল শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ঐতিহ্যগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয় বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী শিল্পকর্ম, রঙ- বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি বহনের মধ্য দিয়ে।

এছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন যেমন- বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বুলবুল ললিত কলা একাডেমি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে এ শোভাযাত্রাটি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এ শোভাযাত্রায় চারুকলা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম চারুকলা ইনস্টিটিউট আয়োজিত আনন্দ শোভযাত্রাই পরবর্তীতে ১৯৯৫ সাল থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে।

নববর্ষ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

বাঙালিদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকে। তিন পার্বত্য জেলায় (বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি) অঞ্চলের নববর্ষ উদযাপন অনেকটা বৈসাবী কেন্দ্রিক। চাকমারা নববর্ষ উৎসবকে ‘বিঝু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা বৈসুক বলে থাকে। এই তিনটি উৎসবের সম্মিলিত নামই বৈসাবী। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী এই ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব সকলে মিলে আনন্দঘন পরিবেশে পালন করে থাকে।

পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ

বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মহাসমারোহে বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকে। সারা চৈত্র মাস ধরে চলতে থাকে নববর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্রের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষুব সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা। এরপর দিন পহেলা বৈশাখে মহাসমারোহে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা হয়।

নববর্ষে বাঙালি

নববর্ষ উদযাপনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। এদিন বাঙালি মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ী এবং পুরুষেরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান করে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে থাকে বিশেষ খাবার বিশেষত পান্তা-ইলিশ, নানা রকম পিঠাপুলির ব্যবস্থা। সর্বোপরি সকল স্তরের বাঙালি নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে উদযাপন করে।

বৈশাখী মেলা

নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তােলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সার্বজনীন লােকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লােকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকলপ্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়।বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। শহরের তুলনায় গ্রামে এ মেলা অধিকতর জাকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। এ মেলার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি কোনো ধর্মীয় ঐতিহ্য নির্ভর নয় বরং এটি বাঙালির সর্ববৃহৎ সার্বজনীন উৎসব। মেলায় চিরায়ত বাঙালি ঐতিহ্য, রীতি-প্রথা ফুটে ওঠে। প্রাচীন বাংলার নানা সংস্কৃতি যেমন- যাত্রা, পুতুল নাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা ইত্যাদি মেলার প্রধান আকর্ষণ।

বৈশাখী মেলাতে নানা রকম কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, মাটির হাঁড়ি, বাসন-কোসন, পুতুল, বেত ও বাঁশের তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, তালপাখা প্রভৃতি পাওয়া যায়। এছাড়া চিড়াঁ, মুড়ি, খৈ, বাতাসাসহ নানারকম মিষ্টান্নের বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে বৈশাখী মেলায়। বর্তমানে এ মেলা সর্ববৃহৎ লোকজ মেলায় পরিণত হয়েছে। এটি মূলত গ্রামীণ জীবনের অনন্য প্রতিফলন। এছাড়া শিশু-কিশােরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লােকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন : চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা ইত্যাদি, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারােহ থাকে।

হালখাতা ও নানা আয়োজন

হালখাতা মূলত ব্যবসায়ীদের পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলার উৎসব। আকবরের সময় থেকেই এটি প্রচলিত হয়ে আসছে। তৎকালীন সময়ে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে হত এবং পহেলা বৈশাখে ভূমি মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের প্রজাদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করত। এটিকেই হালখাতা বলা হয়। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের দিনে পুরনো হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলে।

পুরান ঢাকায় বেশ জাকজকমপূর্ণভাবে “হালখাতা” উৎসব পালিত হয়। এছাড়াও গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, কুস্তি এবং গম্ভীরা, লোকগীতি ও লোকনৃত্যের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে কুস্তি বা বলিখেলার সবচেয়ে বড় আয়োজনটি হয় মূলত চট্টগ্রামে।

নগরজীবনে নববর্ষ উদযাপন

বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমজপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানাের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনাে বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করে। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পােশাক পরিধান করে।

নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আমাদের জীবনেতিহাসের সার্বিক পটভূমিতে এ দিবসের নববর্ষের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম। রূপকথার জিয়ন কাঠির মতাে এ দিনটির মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরােনাে দিনের সকল জরাজীর্ণতা। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা- আশার আলাে নিয়ে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই দিনটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর। বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুজাতি-গােষ্ঠী অধ্যুষিত একটি শান্তির দেশ। 

দিন বদলের পালায় নববর্ষ

মানব সভ্যতার অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথ ধরে সব কিছুতেই লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। এগুলোর মধ্যে কিছু ইতিবাচক আবার বেশকিছু নেতিবাচক। বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাঙালি জনগণ নিজস্ব সংস্কৃতি ও রীতি-নীতির মাধ্যমে এ উৎসব পালন করে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবকে দূষিত করছে। নাচ-গান, মেলা ও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতার স্থান দখল করছে বিদেশি সংস্কৃতি। এতে নববর্ষ উদযাপনের প্রকৃত স্বাদ ও তৃপ্তি থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে।

উৎসব উদযাপনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের বাণিজ্যিকীকরণ ও অতিরিক্ত উম্মাদনা উৎসবের মূল আনন্দকে মলিন করে দিচ্ছে। মানুষ নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ছে। সত্যিকার অর্থে আগেকার দিনের নববর্ষ এবং বর্তমানের মাঝে অপ্রত্যাশিত কিছু পরিবর্তন এসেছে; যা কিনা বাঙালি জাতি এবং তার নিজস্ব সংস্কৃতির উপর হুমকি স্বরূপ। তাই আজ এই সর্ব-বন্দনার পুণ্য-মুহূর্তে আমাদের মনে রাখতে হবে, সমারােহ সহকারে আমােদ প্রমােদ করায় আমাদের উৎসব কলা কিছুমাত্র চরিতার্থ হয় না। তাহার মধ্যে সর্বদলের আন্তরিক প্রসন্নতা ও ইচ্ছাটুকু না থাকিলেই নয়। নববর্ষে যেন ফিরে পাই আমাদের সেই হৃত-গৌরব। আবার যেন আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আন্তরিক প্রসন্নতা ও কল্যাণী ইচ্ছার ভাবরসে। আবার যেন আমরা বর্ষারম্ভের উৎসবে খুঁজে পাই মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করার মহত্ত্ব। আজ নববর্ষ উৎসব ‘সত্যের গৌরবে, প্রেমের গৌরবে, মঙ্গলের গৌরবে, নির্ভীক মহত্বের গৌরবে’ উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক।

উপসংহার

নববর্ষ আমাদের জীবনে কেবল মাত্র একটি উৎসব নয় বরং এটি একটি চেতনার প্রতিরূপক। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে নববর্ষ আমাদেরকে উজ্জীবিত করে একান্তই মানবতাবোধে। এ দিনটি আমাদের দরিদ্র, নিপীড়িত, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা যোগায়। নববর্ষ একদিকে যেমন নির্মল আনন্দের খোরাক, অন্যদিকে তেমনি একটি চেতনার ধারক।

আর তাই কোনো সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস যেন আমাদের ঐতিহ্যকে গ্রাস করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রত্যেক বাঙালিকেই সচেতন হয়ে উঠতে হবে।আসুন পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে আমরা আমাদের মধ্যকার সকল বিভেদ ও দ্বিধা দূর করতে সচেষ্ট হই। আমরা জাগ্রত হই অখণ্ড জাতীয় চেতনায়। আমরা ঋদ্ধ হই আগামীর গর্বিত প্রেরণায়। নতুন বছর আমাদের সবার জীবনে সুখ-সম্ভার বয়ে আনুক এটাই হােক আমাদের প্রত্যাশা। আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি, যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবাে জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযােগ্য করে যাবাে আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার পহেলা বৈশাখ নববর্ষ রচনা। 

এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url