রচনা মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজশাহীর অবদান ইতিহাস (Class 6 7 8 9 10 JSC SSC HSC)

রচনা মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজশাহীর অবদান ইতিহাস (Class 6 7 8 9 10 JSC SSC HSC)
রচনাঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজশাহীর অবদান ইতিহাস
মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের রাজশাহীর অবদান

ভূমিকা

জাতীয় স্বার্থে এদেশের মানুষ যত ইতিহাস রচনা করেছে, তার প্রতি ঘটনাতে রাজশাহী মহানগরী অসীম উদ্দিপনায় সাহসী ভূমিকায় অটল থেকেছেন। এক কথায় সত্য, বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জন ও যে কোন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও সংগ্রাম গড়ে তোলায় এখানকার মানুষের বৈশিষ্ট্য।

জাতির শ্রেষ্ঠ ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধ, যার ভিত্তি মহান ভাষা আনন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে পরবর্তীতে পাক শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন আর অগ্রণতান্ত্রিক আচারণের বিরুদ্ধে যতগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে প্রায় কোনটাতেই এই মহানগরী পিছিয়ে ছিলনা। দেখা যায় ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র লড়াই শুরু হয়েছিল বৃহত্তর রাজশাহীর রহনপুরে (বর্তমানে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত)

মনসুর আহমদ খান সম্পদিত

মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গ্রন্থের ৬৮ প্রষ্ঠায় মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির মন্তব্যে উল্লেখ আছে, ৭১ সালের ২৩ মার্চ একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য রহনপুর ইপিআর ক্যাম্পে সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে গেলে বাঙ্গালী সৈন্যরা পাঞ্জাবী সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পরদিন ২৪ মার্চ একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে কয়েকজন সৈন্য ঘটনা তদন্ত করতে গেলে বাঙ্গালী হাবিলদার আক্কাস পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে গুলি করে হত্যা করেন। ২৩ মার্চের গুলিবর্ষণ ও ২৪ মার্চের পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে হত্যার মধ্যদিয়ে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে মুক্তি পাগল বাঙ্গালী ( মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসির মন্তব্যটি ২০/৭/১৯৯৩ তারিখের আসলাম সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়)।

রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে শুরু হলেও এদেশের মানুষ তার পূর্বেই মানসিকভাবেই আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নিবার্চনের বিজয় তারই ফলশ্রুতি। পাক শাসকগোষ্ঠীর গণতন্ত্র ও এদেশের মানুষের প্রতি যে বিন্দু মাত্র ভক্তি ও ভালবাসা ছিলনা তা এই নিবার্চনের ফলাফল থেকেই অত্যন্ত স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ সামরিক প্রেসিডেন্ট লেঃজেঃ ইয়াহিয়া খান ও মার্চে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঘোষণা করার পরপরই বাংলাদেশের তৎকালের পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র মানুষ জ্বলে উঠেছিল। বিক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল রাজশাহীতেও। ১ মার্চ দুপুরে রাজশাহী কলেজে খুরশিদ বিন আলমের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস (সাবেক প্রতিমন্ত্রী) ঐ সভায় ভাষণ দেন। এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা আব্দুস সামাদ, মাহফুজুর রহমান খান, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হাবিবুর রহমান টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় একটি ছোট পাকিস্তানী পাতাকায় আগুন লাগানো হয়। খুরশিদ আলম কলেজ অফিসের ছাদে উঠে পাকিস্তানী পাতাকাটিতে আগুন লাগান। সভা শেষে কোর্ট অভিমুখে মিছিল বের হয়। ঐ মিছিল বেতার কেন্দ্র, এসপি অফিস, ডিসি অফিস, জজ কোর্টের ‍পাতাকাতে আগুন ধরায়। ঐ দিন রাজশাহী কলেজের ঐ সভায় এক দফা স্বাধীনতার দাবি করা হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ ১ মার্চ হতে ৩ মার্চ ক্যাম্পাসে ও শহরে জঙ্গী মিছিল বের করেছিল। ৩ মার্চ হরতাল ও মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোর্ট পযর্ন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদ গর্জে উঠেছিল মিছিলে মিছিলে। পুলিশ লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস ও গুলি নিক্ষেপ করে মিছিলে বর্বরতা চালায়। বেলা ‍সাড়ে এগারটার দিকে মালোপাড়া টেলিফোন ভবনের ওপর থেকে বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবষর্ণ করে বাটার মোড়ে একজন ছাত্রকে হত্যা করে। এর ফলে রাজশাহীর ছাত্র, বুদ্ধিজীবীসহ সব পেশার মানুষ আরো অশান্ত হয়ে ওঠেন। পাক বাহিনী সান্ধ্য আইন জারী করেছিল এবং ১২ ঘন্টার সময় দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। উপাচার্য এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অপসারিত হন। ৫ মার্চ গুলিবষর্ণের প্রতিবাদে ভুবনমোহন পার্কে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ সভা করে। এদিন পাকসেনারা সাহেব বাজারের শাকসজি লুট করে নিয়ে যায়।

৮ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা মিয়াপাড়াস্থ সাধারণ গ্রস্থাগারের চত্বরে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যোদ্ধা বাছাই কর্মসূচি শুরু করে এবং যুবকরা দলে দলে যোগ দেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মালেক চৌধুরী। ১০ মার্চ রাজশাহী শহর থেকে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয়। ১১ মার্চ ভুবন মোহন ‍পার্কের জনসভায় এএইচএম কামারুজ্জামান ভাষন দেন। ১২ মার্চ ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুসহ অন্যান্য শিল্পীরা স্বাধীনতার স্বপক্ষে রাজশাহীর বিভিন্ন রাস্তায় গণ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এদিন রাতে বোমা বানানোর রসদ সংগ্রহের জন্য কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সায়েন্স ল্যাবরেটরী লুট হয়। ১৩ মার্চ জনতার আন্দোলন আরো জোরদার হয়ে ওঠে। ১৪, ১৫ ও ১৬ মার্চ সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপকভাবে মাঠে নামে এবং শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে পথে পথে, ম্মুক্ত মঞ্চে ট্রাকযোগে দেশাত্মবোধক গান, গণসংগীত, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৭ মার্চ স্বাধীণ বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহবায়ক হয়েছিলেন আব্দুল কুদ্দুস ও শরিফ উদ্দিন। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজশাহী মহানগরীতে উদ্দীপনামূলক গণসংতীতের আয়োজন করে। ১৮ মার্চ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছাত্র কর্মীদের দ্বারা বানানো বোমা পরীক্ষামূলকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ১৯ মার্চ ভাটাপাড়া লক্ষীপুরে গঠন করা হয় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। এদিনই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২০ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে নগরীব্যাপী কালো পতাকা উড়ানো হয়। ২১ মার্চ নগরীব্যাপী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছোট ছোট ইউনিট গঠন করে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করার উদ্দেশ্যে যুবকদের একত্রিত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২২ মার্চ থেকে প্রকাশ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয় এবং রাতে একটি স্কুলের সায়েন্স ল্যাবরেটরী লুট হয়।

২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসে আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ লাইনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশীহী কলেজ তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান রাজশাহী ও রাজশাহী কোর্টেও পতাকা উত্তেলন করা হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন, ডাঃ আব্দুল মান্নান, মাহফুজুর রহমান খান, আব্দূল মান্নান প্রমুখের নেতৃত্বে নগরীতে ছাত্র- যুবকের সমন্বয়ে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ মার্চ সেনাবাহিনীর টহলের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর টহল চলে মহল্লায় মহল্লায়। ২৫ মার্চ মিছিল ও দিবাগত রাতে ভুবন মোহন পার্কে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে রক্ত কথা বলে নাটক মঞ্চস্থ হয়। (মুনসুর রহমান খান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের রাজশাহী গ্রস্থে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ভুবন মোহন পার্কে অনুষ্ঠিত নাটকটির নাম রক্ত কথা বলে উল্লেখ থাকলে ও রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ ২০০৩ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় নাটকটি রক্তের রঙ লাল নামে উল্লেখ আছে।) এটি রচনা করেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব ও চলচ্চিত্র শিল্পী আতাউর রহমান।

পাক সরকারের নির্দেশে ২৭ মার্চ লাইসেন্সকৃত বন্দুক জমাদান শুরু হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় জমা দেওয়ার পথে সাহসী যুবকেরা এসব বন্দুক কেড়ে নিয়েছিল যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। বন্দুক কাড়াকাড়ির নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ সারোয়ার হোসেন, ডাঃ শাফিক প্রমুখ। ২৮ মার্চ পাক আর্মি ও পুলিশের যুদ্ধ চালাকালে পুলিশ লাইনের পাশ্ববতী এলাকায় বুলনপুর, ভেড়িপাড়াসহ কোর্ট এলাকা ও নগরীর সাধারণ মানুষ খাদ্যসহ পুলিশকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। কোর্ট বাজারের ডাক্তার গাফফারের বাড়ীকে হেড কোয়ার্টার বানিয়ে ঐ অঞ্চলের মানুষ সংগঠিত হন ও বিভিন্ন তৎপরতা আরম্ভ করেন। নগরীর পূবাঞ্চলে তালাইমারী মহল্লায় জেবের মিয়ার নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণ ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। শেখর চক ও আলুপট্টি এলাকায় সূর্যশিখা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কার্যালয়ে ও হেতমখায়ে মুসলিম হাই স্কুলের ভিতরে একটি কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এভাবে নগরীর সবর্ত্র কারো না কারো নেতৃত্বে যুদ্ধেচ্ছুক যুব শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হয়। ১ এপ্রিল পযর্ন্ত পুলিশ, আনসার, দু-একজন প্রাক্তান সৈন্য, ইউওটিসি ও মুজাহিদ ট্রেনিং প্রাপ্তদের সহযোগিতায় প্রতিরোধ যুদ্ধ, চোরাগুপ্ত হামলা ও রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। পুলিশ লাইনের পতনের দিনই কোর্ট এলাকায় বশড়ি ইট ভাটার কাছে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার হারুন উর রশিদের নেতৃত্বে পাক সেনাদের একটি টহল দলে আক্রমণ করা হয়। এতে একজন পাক সেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। সম্ভবত রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনার মৃত্যু এটাই প্রথম। ৩১ মার্চ রাজশাহী-নওগাঁর ইপিআর এর ৭নং উইং এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, ৭নং উইং এ সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার মেজর নজমুল হক এক কোম্পানী ইপিআর নিয়ে রাজশাহী পৌছে নগরীর উত্তরে নওহাটায় অবস্থান গ্রহণ করেন। চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে ৫০০ জন ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও ছাত্রদের সমন্বিত একদল মুক্তিযোদ্ধা নগরীর অদূরে পশ্চিমে এসে পৌছে। সারদা ক্যাডেট কলেজে কর্মরত ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পূর্ব দিক থেকে রাজশাহী নগরীর দিকে অগ্রসর হয়।

এ ঘটনার ফলে প্রতিরোধ যুদ্ধের গতি সঞ্চারিত হয়। ঐ দিন রাতেই আলোচনার মাধ্যমে ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহীর প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২ এপ্রিল ভোরে ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে নগরীর পশ্চিম দিক থেকে একদল মুক্তিযোদ্ধা কাঠালবাড়িয়া আমবাগান এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বেও একদল মুক্তিযোদ্ধা পূর্ব দিকে ভদ্রা এলাকায় অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বাধীন ইপিআর সুবেদার লস্করের নেতৃত্বে তার বাহিনী পূর্ব দিক থেকে নগরীতে ঢুকে পড়লেও পরে ফিরে যায় হর্টিকালচারের পাশে জেবের মিয়ার ইটভাটার কাছে। এদিকে ঢাকা থেকে আগত পাকিস্তানী যুদ্ধ বিমান হামলা চালিয়ে বেসামরিক লোককে হত্যা ও ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে। কেন্দ্রীয় কারাগারও আক্রান্ত হয়। এর ফলে বন্দীরা লকআপে না গিয়ে সবাই ৩ এপ্রিল জেল ভেঙ্গে পালিয়ে যায়। এসময় কারা রক্ষীদের গুলিতে ১৪ জন কয়েদি মৃত্যুবরণ করেন। ৬ এপ্রিল পযর্ন্ত পাক বাহিনী নগরীর কয়েকটি গুরুত্বপূণ স্থানে অবস্থান নিয়ে থাকে। এরপর ক্যাপ্টেন গিয়াস একদল সৈন্য সমেত বগুড়া ও মেজর নজমুল রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসেন। পরে ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী অভিমুখে অগ্রসরমান মূল দলের সঙ্গে যোগ দেন। গিয়াসের নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার, পুলিশ, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার মানুষ মিলে এক হাজার সৈন্য এবং সারদা হতে এক হাজার সৈন্য ২ এপ্রিল রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে সমবেত হয়। ৩ এপ্রিল বিএসএফ এর লেঃ কর্ণেল সেন ও মেজর ত্রিবেদী ক্যাপ্টেন গিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস রাজশাহী শক্রমুক্ত করার জন্য তাদের নিকট প্রয়েজনীয় সাহায্য চেয়ে না পেয়ে অবশেষে পরিকল্পনা মাফিক ৬ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬-৭টার দিকে শক্রদের ওপর প্রবল আক্রমণ করেন। অদম্য সাহসের মধ্য দিয়ে প্রায় চার ঘন্টা লড়াই এর পর রাজশাহী শক্রমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা শহরের চতুর্দিকে তাদের প্রতিরক্ষা তৈরী করে। এ যুদ্ধে কিছু সংখ্যক পাক সেনা নিহত হয় ও ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে প্রয় তিন হাজার অস্ত্র ও তিন লাখ গুলি উদ্ধার করে। শহরের লোকের মধ্যে উল্লাস দেখা দেয়। এদিকে পাক সেনারা তাদের ছাউনি পশ্চাদপসরণ করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে। তারা বিমান হামলাও আরম্ভ করে। মুক্তিযোদ্ধারা ৭-১০ এপ্রিল ৩০০/৪০০ গজের মধ্যে পাক সেনা ছাউনির ‍চতুদিকে ঘিরে ফেলে। এতে পাক সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সে এলাকার বিহারীদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরীতে সাহ্যায্যের নির্দেশ দেয়। তার পূর্ব থেকেই বিহারী কলোনীর বিহারীরা পাক বাহিনীর ছত্র ছায়ায় ঐ এলাকায় বসবাসকারী ও পথচারীর অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

৮ই এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০ টায় ডাক বাংলায় (বতমান আর এম পি হেড কোয়ার্টার) আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাড. আব্দূল হাদীকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এ সভায় আব্দুল হাদী, ক্যাপ্টেন গিয়াস, মোস্তাফিজুর রহমান খান, মাহতাব উদ্দিন, শফিকুর রহমান রাজা, মহসীন আলী, সাইদুর রহমান, ডাঃ টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এসময় নির্বাচিত এমএনএ এ এইচ এম কামারুজ্জামান হেনা কৌশলগত কারণে কোলকাতায় অবস্থান করছিলেন। ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে গণবাহিনী প্রধান মাহতাব উদ্দিন ও শফিকুর রহমান রাজা তাকে রাজশাহীতে আনার জন্য ভারত গমন করেন। ‍তারা মুর্শিদাবাদ প্রশাসনের সহযোগিতায় ১২ এপ্রিল বিকেলে সাজসরঞ্জমসহ বিবিসির রিপোর্টারদের রাজশাহী নিয়ে আসেন। তারা মিশন হাসপাতালে এক সময়ের সহকারী ভারতীয় হাই কমিশনারের বাসভবনে অবস্থান করেন এবং কাঠালবাড়িয়া আমবাগানের পার্শ্বে প্রাইমারী স্কুলে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের কোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন গিয়াসের সাক্ষাৎ নেন এবং বেশ কিছু চিত্র ভিডিওতে ধারণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাক সেনা ছাউনি দখলের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত তখন ১০ এপ্রিল পাক সেনাদের দুই ডিভিশেন সৈন্য হেলিকপ্টার, স্টিমার ও ফেরীর মাধ্যমে নগরবাড়ী ঘাটে অবতরণ করে। খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ বাধা দেয়ার জন্য নগরবাড়ী অভিমুখে রওনা দেন। তারা ১১ ও ১২ এপ্রিল পাবনার মুলাডুলী, রাজশাহীর সারদা রোডের মোড় ও শহরের অনতিদূরে কয়েকটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করেও টিকতে পারেননি। সারদার কাছে তুমুল যুদ্ধে কোম্পানী কমান্ডার এবি সিদ্দিকিসহ (সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক) বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। (শহীদ এবি সিদ্দিকিকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।)

১৩ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয় পৌছে আর্টিলারী ফায়ার ও জংগী বিমানের গোলা বষর্ণ আব্যাহত রাখে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা, জিন্নাহ ও অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। হাবিব ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরী প্রভৃতিতে লুটতরাজ চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়েকে কেন্দ্র করে তারা আশেপাশের এলাকাতেও হত্যা ও নিযাতন আরম্ভ করে। ঐদিন বিমান হামলায় মুসলিম হাই স্কুলে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার তছনছ হয়ে যায়। ১৪ এপ্রিল রাত দুটার দিকে পাক গোলন্দাজ বাহিনী বৃষ্টির মত গোলা বষর্ণ শুরু করে ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাদের এক ডিভিশণ সৈনা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রচন্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে মূল দলটি চাঁপাই নবাবগঞ্জের দিকে সরে আসতে বাধ্য হন। এর ফলে রাজশাহী শহর পাক সেনাদের দখলে চেলে যায়। স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় পাক বাহিনী নগরীতে হত্যা, ধষর্ণ, লুট, আগুন জ্বালানোসহ ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বেলা প্রায় দুটার দিকে ক্যাপ্টেন গিয়াস তার সাথীদের মধ্যে ৩০০ জনকে খুজে পান। তাদের নিয়েই তিনি রাজশাহী শহর থেকে ১৮ মাইল পশ্চিমে ও চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে ১২ মাইল পূর্বে গোদাগাড়ী নামক জায়গায় পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করেন। এখান থেকে নুরুল ইসলাম নামে একজন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা ১৫ এপ্রিল ও ১৬ এপ্রিল নুরুল ইসলামসহ ক্যাপ্টেন গিয়াস মুর্শিদাবাদের জেলা প্রশাসক ও বিএস এফ এর সঙ্গে দেখা করেও সাহায্য পাননি। ১৭ থেকে ২০ এপ্রিল পাক সেনারা জঙ্গী বিমানের মাধ্যমে গোদাগাড়ী মুক্তিযোদ্ধা ঘাটি ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে গোলাবষর্ণ করে। এর ফলে চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের লোকজন পালিয়ে যায়। ২১ এপ্রিল খুব ভোর থেকে পাক সেনারা প্রবল গোলা বষর্ণ আরম্ভ করে। এর ফলে বেলা ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের গোদাগাড়ি প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। পাক সেনারা চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহর দখল করে নেয়। ইপিআরের ২ টি স্পীড বোট দিয়ে সমস্ত গোলাবারুদসহ মুক্তিযোদ্দাদের নিয়ে ক্যাপ্টেন গিয়াস পদ্মা নদীর চরে আশ্রয় গ্রহণ করেন।এদিকে ক্যাপ্টেন রশিদ চারঘাট এলাকা থেকে তার দল নিয়ে পদ্মা অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেয়। কেবল চর ছাড়া রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ সমগ্র এলাকা পাক সেনাদের দখলভুক্ত হয়।

এদিকে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশেকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়াও দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে ৭নং সেক্টর গঠিত হয়। এই সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল লেঃ কর্ণেল নুরুজ্জামানকে। এই সেক্টরকে ৯টি সাব সেক্টরে বিভক্ত করে ৯ জন সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছিল। (মনসুর আহমদ খান সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী গ্রন্থে ওয়াহিদা আহমেদ মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী প্রবন্ধে ন'জন সাব সেক্টর কামান্ডারের উপরোক্ত নাম উল্লেখ থাকলেও গিয়াস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম ০৯.০৪.২০০৭ তারিখে স্বাক্ষরিত আত্মজীবনীতে ৪ নং সাব সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার থাকার কথা উল্লেখ করেছেন) এই সাব সেক্টরগুলো ব্যতীত স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্নভাবে রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ করেন।

২৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আসাদ আহমদ বায়রনের নেতৃত্বে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানপুরে এক গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে নাম নাজানা মাত্র এগার বছরের এক কিশোরের দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে বীরত্বের পরিচয় দেয়। রাত সাড়ে নটার দিকে দুর্লভপুর গেরিলা শিবির থেকে বায়রনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা নৌকা যাত্রা আরম্ভ করে। রাত পৌনে এগারটায় কানপুরের নিকট পৌছে একটা আখক্ষেতে নৌকা বেধে ঐ দুঃসাহসী কিশোরের পথ নির্দেশনায় এক বুক পানি ভেঙ্গে যাত্রা আরম্ভ করেছিল। একটা আমবাগানে পৌছতেই শিবগঞ্জ ক্যাম্প থেকে পাক সেনারা গোলাগুলি শুরু করে। বাগানের মধ্যে দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয়েছিল। এরপর কাছে নিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবী ও রাজাকারদের ট্রেঞ্চ ও বাংকারগুলো দেখিয়ে দিয়ে নিজেই ক্রলিং করে পাহারারত রাজাকারকে গলা টিপে হত্যা করে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল এই কিশোরটি। দলীয় নেতার নির্দেশমত পাঞ্জাবী বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করেছিল গেরিলারা। প্রচন্ড বিস্ফোরণের সংগে সংগে বাংকার ধ্বসে পড়ে এবং অবস্থানরত তিনজন পাঞ্জাবীই প্রাণ হারিয়েছিল। পাশের বাংকারে গ্রেনেড চার্জের ফলে চারজন রাজাকার মারা পড়ে । পার্শ্ববর্তী এক বাড়ি থেকে দুজন রাজাকার ও তিনজন দালাল পাঞ্জাবীদের কাছে খবর দেবার উদ্দেশ্যে পালানোর পথে গেরিলাদের লক্ষ্য অভ্রষ্ট গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে পাঞ্জাবীরা খবর পেয়ে এক কোম্পানী সেনা ও রাজাকার নিয়ে আক্রমণের জন্য রওনা হয়। আখ ক্ষেতে রেখে আসা নৌকার পাহারারত গেরিলারা গুলি ছুড়ে এই পাঞ্জাবী কোম্পানীকে প্রচন্ডভাবে ঘাবড়ে দেয়। তারা ভালভাবে কিছু বোঝার পূর্বেই গেরিলা মুক্তিবাহিনী নৌকায় ফিরে আসে। ফলে বায়রনেরর নেতৃত্বে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কানপুর অপারেশন সফল হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধারা একটি এলএমজি, দুটি চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলসহ বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছিল।

১০ মে নায়েব সুবেদার মুবাশ্বেরুলের নেতৃত্বাধীন একটি দল চারঘাট থানা রেড করেন। এতে মিলিশিয়াসহ ১০ জন পাক সেনা নিহত হয় ও ৭ জন আহত হয়। ১৩ মে হাবিলাদার খন্দকার আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে এক সেকশন মুক্তিযোদ্ধা সারদা পিটিসির পাকসেনা ঘাটি আক্রমণ করে ৬ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। ১ জুন পাক কতৃর্পক্ষ রাজশাহী শহরে কলেজ, বিশ্ববিদ্যায় খোলার নির্দেশ জারী করেছিল। ১ জুলাই শিক্ষকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয় এবং ক্লাশ শুরু হয়েছিল ২ আগষ্ট। ২৩ জুন মুক্তিযোদ্ধারা প্রথাম গ্রেনেড হামলা করেছিল। ফলে পাওয়ার হাউজের প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল এবং শহরে দুদিন বিদ্যুৎ ছিলনা। মোঃ আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এই হামলা চালায়।

সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে ১০ আগষ্ট পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর শিবগঞ্জ থানার কলাবাড়ীতে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৬৪ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেছিলেন। সুবেদার মেজর মজিদ তার দলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ভোর সাড়ে পাঁচটায় পাক সেনাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং দেড় ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর কলাবাড়ী মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে।

২২ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার অন্তভুর্ক্ত পাকঘাঁটি মীরগঞ্জ বিওপি আক্রমণ করলে পাক সেনাদের পাল্টা আক্রমণে পিছু হটে আসে। ২৩ আগস্ট ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও সুবেদার মেজর মজিদ যৌথভাবে পাক বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি কানসাট আক্রমণ করেন। পাক বাহিনীর প্রতিরোধ আক্রমণে মুক্তি বাহিনী ঐ দিন কানসাট থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। ২৬ আগস্ট পুনরায় কনসাটে যুদ্ধ হয়। প্রথমে মুক্তি বাহিনীর তীব্র আক্রমণে পাকসেনারা কানসাট ছেড়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই তারা পাল্টা আক্রমণ ও প্রচন্ডভাবে গোলাবর্ষণ করে। এই আঘাতে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে ৭নং সেক্টরের প্রতিটি সেক্টরেই পাকসেনাদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা অবিরামভাবে আক্রমণ চালান।

অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী

৭ অক্টোবর রাজশাহী মহনগরীর কুঞ্জ মৈত্রের বাড়ির বৃহত্তম রাজাকার ঘাঁটি ও মোসলেম সাহেবের বাড়ির আলবদরের দপ্তর ধ্বংস করার জন্য বীরাঙ্গণা শওকত আরা একটি অভিযান চালিয়েছিলেন। এই সাহসী নারী পরিকল্পনা মাফিক একটি ২৪ ইঞ্চি টিনের ট্যাংকে ৪টি এ্যান্টি ট্যাংক মাইন, এক্সপ্লোসিভ ও ৪টি এসএমজি, বেশ কিছু গ্রেনেড ও কারবাইনের ম্যাগজিন ভর্তি করে একটি রিক্সা শহরে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরিকল্পনা সফল হয়নি।

১৪ অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাকসেনা ও রাজাকারদের সংঘর্ষে একজন পাক মেজরসহ ৩০ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। ২২ নভেম্বর শাহপুর গড়ে মুক্তি যোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ শুরু হয়। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার শাহপুর গড়ের যুদ্ধই ছিল সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। পাক বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল এবং শাহপুর গড় ছেড়ে তারা দলদলিতে চলে এসেছিল এবং অনেকে নদী অতিক্রম করে আলীনগরেও চলে গিয়েছিল। পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা শাহপুর গড় পুনর্দখলের অভিযান আরম্ভ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মেহেদীপুর থেকে তার বাহিনী নিয়ে এসে শাহপুর গড় আক্রমণ করেন। লেঃ রফিক, নজরুল, আলতাফ, ওয়াশিল এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। প্রায় দেড় ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর পাকসেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিযে যায়। সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল নুরুজ্জামান এযুদ্ধের নেতৃত্বে দেন। এরপর আলীনগর ব্রিজের কাছে আক্রমণ চালালে পাঁচ পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া মোঃ রফিকের নেতৃত্বে আমবাগানে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করলে বহু পাকসেনা হতাহত হয় ও একজন পাক মেজর ধরা পড়ে । এযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান শহীদ হন। ২৭ নভেম্বর ক্যাপ্টেন গিয়াসের নির্দেশে মুক্তি বাহিনীর ৫টি কোম্পানী পাকিস্তানসেনাদের শক্ত ঘাঁটি পোড়াগ্রাম আক্রমণ করে। দীর্ঘ স্থায়ী এই সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং পাকসেনারা শেষ পযন্ত চাঁপাই নবাবগঞ্জে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

১০ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা চাঁপাই নবাবগঞ্জের ওপর ব্যাপক হামলা আরম্ভ করে এবং এখানেই এক যুদ্ধে ১৪ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহীদ হন। এই দিনই চাঁপাই নাবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। ১৫ ডিসেম্বর সম্মিলিত মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী রাজশাহী প্রবেশ করলে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বস্তুত ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহী পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে পুরো সেক্টর এলাকা মুক্ত হয়। ১৭ ডিসেম্বর সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও আশেপাশে মোতায়েনকৃত পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। এদিন কাজী আমিরুল করিমের নেতৃত্বে মোঃ শরিফুল ইসলাম, আবু আলম, নূর এলাহী খোকনসহ রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১০ম শ্রেণীর মোট ৫ জন ছাত্র অত্র স্কুলের ছাদে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত জাতীয় পতাকা উড়ান। পতাকাটি মাছ ধরা ছিপের লাঠিতে উড়ানো হয়েছিল। মাস্টার পাড়ার বাড়িতে অবস্থানরত প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানকে ছাত্ররা এ সময় বাড়ি থেকে ডেকে এনে উপস্থিত করেছিলেন। পতাকাটি বানিয়েছিলেন আমিরুলের বড় বোন ফাতেমা আখতারী। এর দৈর্ঘ্য ছিল দেড় ফিট। ১৮ ডিসেম্বর খুব ভোরে পাক সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নাটোর চলে যায় এবং সেখানে বিকেলে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের নিকট আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনারা ছেড়ে যাবার পর ১৮ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে জোহা হলে আবস্থান নেয় ও ক্যাপ্টেন গিয়াস বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বদিউজ্জামান টুনু ও নূর হামীম রিজভীকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

উপসংহার

রাজশাহী বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি সমাবেশ ২০০৩ স্মরণিকা থেকে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহী শহর শক্রমুক্ত হলেও চাঁপাই নবাবগঞ্জের দিক থেকে ৪নং সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহী এসে পৌছান। ১৮ ডিসেম্বর শহরবাসী মাদ্রসা ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রধান করেন। উত্তরাঞ্চলে অবস্থানরত পাক সেনারা ১০ ডিসেম্বর নাটোরে সমাবেত হয়ে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।

কৌণিক বার্তা.কম কে সাহায্য করোঃ
রচনাটি সম্পূর্ণ করার জন্য কিছু পয়েন্ট প্রয়োজন। আপনি চাইলে কিছু পয়েন্ট দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন। নতুন রচনা লিখে দিতে চাইলে দিতে পারবেন, ধন্যবাদ।


বাংলা রচনার সম্পূর্ণ তালিকা


আপনি পিডিএফ ফাইল ডাউনলোড করতে পারবেন 200 সেকেন্ড পর


বাংলা প্রবন্ধ রচনা তালিকা


সবগুলো #

এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url