কবি কাজী নজরুল ইসলাম - রচনা | Kazi Nazrul Islam

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী'কবি।রচনায় নজরুল ইসলামের জন্ম-মৃত্যু, পারিবারিক,কর্মজীবন,সাহিত্যিক জীবন, সম্মাননা সম্পর্কে জানব।

বিষয়ঃ রচনা কবি কাজী নজরুল ইসলাম | Kazi Nazrul Islam

শ্রেণীঃ Class 6 7 8 9 10 | SSC  HSC JSC

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কবি কাজী নজরুল ইসলাম - রচনা | Kazi Nazrul Islam
কাজী নজরুল ইসলাম - রচনা | Kazi Nazrul Islam

ভূমিকা

যে কবির কবিতায় হৃদয়ে স্পন্দন জাগে, রক্তে তোলে শিহরণ তিনি আর কেউ না আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামই। তিনি আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্বও। তাঁর লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাসে লুকিয়ে ছিল সমগ্র ভারতবষের মনুষের মুক্তির সংগ্রামের বাণী। তাঁর কিছু লেখনীতে প্রকাশ পেয়েছে সাবলীল ভাব। যার জন্য তাঁকে কারাবরণ হয়েছিল। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি অবাধে বিচরণ করলেও মূলত বিদ্রোহী কবি হিসেবেই তিনি আমাদের কাছে এবং বিদেশেও পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে আমি আমার চিন্তা-চেতনার প্রকাশ দেখতে পাই, এঘনাই তিনি আমার প্রিয় লেখক। ছোটবেলায় তাঁর আমি হব সকাল বেলার পাখি” কবিতাটি মুখস্থ করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই কবির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সেই আকর্ষণ কখনে মন হয় নি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহ করেছিলেন সকল অন্যায়, অতাচার, অসত্য, শোষণ-নির্যাতন আর দুঃখ-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে।

কবি প্রতিভা

রবীন্দ্র-প্রতিভার জয়গানে বাংলা সাহিত্য যখন মুখরিত, ঠিক তখনই সম্পূর্ণ এক নতুন অথচ কালজয়ী প্রতিভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে আবির্ভূত হন কাজী নজরুল ইসলাম। বক্তব্যের বলিষ্ঠতা, প্রকাশভঙ্গির যাতস্থা, ভাষা ও ছন্দের বৈচিত্র্য এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব সব মিলিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠা।

জন্ম ও শৈশবকাল

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ইংরেজি ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কাজী নজরুল ইসলমের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া” । তিনার গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এখানে কাজ করার সময় কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র নয় বছর। তাঁর পিতা মৃত্যুর পর তাদের পরিবারিক অভাব-অনটনের কারণে নজরুল তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং কাজী নজরুল ইমলাম মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। তিনি মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। কাজী নজরুল কিছুদিন স্থানীয় মাজারে খাদেম, মসজিদে ইমামতি ও মোল্লাগিরি করেন। কাজী নজরুল এর জম্মের পূর্বে তার একাধিক ভাইবোন মারা যায়ও তার পিতা-মাতা ছোটবেলায় তাঁকে “দুখু মিয়” বলে ডাকতেন। এগার বছর বয়সে সাহিত্যাকানে তাঁর প্রথম ভীৰু পদচারণা। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় উনিশ বছর বয়সে প্রথম মহাযুদ্ধে তিনি বাঙালি পল্টনে যোগ দেন। যুদ্ধের দামামার মধ্যেও তাঁর সাহিত্যচর্চা থেমে থাকে নি। তখন থেকেই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এক নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। তিনি মক্তবে কাজের মাধ্যমে অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিতি পাই। কাজী নজরুল পরবর্তীকালে সাহিত্যকর্ম বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনি বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং স্থানীয় একটি লেটো দলে যোগ দেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। এবং ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।

কাজী নজরুল ইসলাম তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন -

“কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”

শিক্ষা জীবন

কাজী নজরুল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই মুক্তমনা মানুষ। তাঁর স্কুলের বাঁধাধরা জীবন ভালো লাগতো না। তাছাড়া তাঁর পিতা মৃত্যুর কারণে পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে তাঁর পড়াশোনা কারতে পারেনি। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। তিনি তাদের গ্রামের এক মক্তবে পড়াশুনা করতেন। সেখান থেকে নিম্ন মাধ্যমিক শেষ করেন । তিনি ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে স্কুল জীবনে ফিরে আসেন। নতুন ছাত্রজীবন শুরৃ করেন রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল (Searsole Raj High School) , এরপর মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর পারিবারিক আর্থিক সমস্যার জন্য বেশি দিন পড়াশোনা করতে পারেনি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পরে আবার তার কর্ম জীবনে ফিরে যেতে হয়। প্রথশে যোগ দেন একটি কবিদলে এর পর রেলওয়ে গাডের খানসামা সবশেষে একটি চা-রুটির দোকানে কাজ করেন। কাজী নজরুলের বাল্য জীবনে বেশ কষ্টের মাঋ দিয়ে অতিবাহিত হতে থাকে। রফিজউল্লাহ নজরুলের প্রতিভা দেখে তাঁকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ , ত্রিমালের , দারিরামপুর স্কুলে ( বর্তমান নাম ত্রিশাল সরকারি নজরুল একাডেমি ) সপ্তম শ্রেণীতে আবার ভর্তি হয়। তিনি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল ফিরে যান এবং অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর ১৯১৭ সালে আবার সে কর্ম জীবনে সৈনিক হিসেবে ফিরে জান।

বিদ্রোহী নজরুল

বিদ্রোহী নজরুল - Kazi Nazrul Islam
বিদ্রোহী নজরুল
সেই সময় দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে “এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে” প্রভৃতি। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে কাজী নজরুল ইসলাম 'বিদ্রোহী' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কস্তুত 'বিদ্রোহী' কবিতা নিয়েই কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-প্রভাবকে অতিক্রম করে এক নব যুগের সূচনা করেন। সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। অত্যন্ত সাহসের সাথে কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করলেন-

“মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের এখন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর রণভূমে রণিবে না।
বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।"

কাজী নজরুল ইসলামক এর রাজনৈতিক কবিতা “আনন্দময়ীর আগমনে” প্রকাশিত হওয়ার পর তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করেন। এরপর তাঁকে কুমিল্ল থেকে কলকাতায় নিয় যান। ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

পারিবারিক জীবন

কজী নজরুল ইসলাম মুসলিম সাহিত্য সমিতি আফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন ১৯২১ সালের দিকে। তার সথে প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দীর দেবীর বাড়িতে যান। এরপর পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে পরে বিয়ে হয়েছিল। নজরুলের বিয়ে নাগিস আসার খানমের সাথে আথদ সম্পন্ন হবার পর কাবিনে নজরুলকে ঘর জামাই থাকার শর্ত দেওয়া বাসর সম্পন্ন করার আগেই নাগিসকে রেখে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যাই । সেই সময় নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন এবং পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পরে প্রমিলার নাম দেওয়া হয়েছিল "আশালতা"। এরপর প্রায় ১৫ বছর পরে নজরুলের সাথে নার্গিসের দেখা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।

কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তার চার সন্তান ছিলে। তাদের নাম কৃষ্ণ, মুহম্মাদ, অরিন্দম খালেক কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুন্ধ।

কর্মজীবন

কাজী নজরুল তার পারিবারিক আথিক অসচ্ছলতার কারণে অল্প বয়সে থেকেই কাজ করতে হয় । যে বয়স ছিল হাসি-খুশির , চঞ্চলের বয়স সেই বয়সেই কবিকে ধরতে হয়ছিল কর্মজীবনের হাল। তার মাত্র আট বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর পরিবারের আথিক অবস্থা হয়ে পড়েছিলে খারাপ । সেই কবি জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয়। লেটো দল ছেড়ে আবার পড়াশুনায় মন দিলেও পরবর্তীতে তাকে আবার কাজে নামতে হয়। যোগ দেন বাসুদেবের কবি দলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবেই কষ্টে কেটেছিল জাতীয় কবি নজরুলের বাল্যকাল। এর আগে কবি কাজ করেন মক্তবেই শিক্ষকতা এবং মসজিদের মুয়াযযিন হিসেবে কাজ শুরু করে ছিলেন।

সৈনিক জীবন

কাজী নজরুল সৈনিক জীবন | Nazrul in British Army
নজরুল সৈনিক জীবন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে সমগ্র ইউরোপে ১৯১৪ সালে। নজরুল তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তিনি ৪৯ নম্বর বাঙ্গালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে চলে যান করাচি। নিজ দক্ষতায় অল্পদিনের মধ্যে নজরুল হাবিলদার পদে উন্নীত হন। সেনা শিবিরে ব্যস্ততার মাঝেও তিনি সাহিত্য চর্চার চালিয়ে যান। করাচি থেকেই তিনি কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠান। তার প্রথম লেখা “বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী” নামে একটি গল্প এবং প্রথম কবিতা “মুক্তি”। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

সাংবাদিক জীবন

কাজী নজরুল ইসলাম সাংবাদিক জীবন
সাংবাদিক জীবন
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকেই তাঁর সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজ শুরু হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় যেমন মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার পত্রিকায় তার খেয়া পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুইটি প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। নজরুলের সাংবাদিকতা শুরু হয় ১৯২০ সালে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকার নিয়মিত সাংবাদিকতা করতেন নজরুল। সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় নজরুলের প্রথম গান "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন" প্রকাশিত হয়।

রাজনৈতিক জীবন

কবি কাজী নজরুল সাহিত্যকর্ম ছাড়াও রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। সৈনিক জীবন ত্যাগ করার পর রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়। তাঁর সঙ্গ ছিলেন এদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত মুজফ্ফর আহমদ । এর পর তিনি রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বকতৃতায় অংশ নিতেন। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লক তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে ১৯১৭ সালে। তিনি ফুটে উঠার তার লেখা সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছতে। তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। তিনি ১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নিবার্চনে অংশগ্রহণের চেষ্টা করেন। তিনি তেমন সাফল্য পান নি। তিরি সাহিত্য এর মাধ্যমে রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করতে থাকে এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়।

চলচ্চিত্র

১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’র ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন তিনি। নজরুল ‘ধূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাপুড়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ও সুরকার ছিলেন তিনি। ‘রজত জয়ন্তী’, ‘নন্দিনী’, ‘দিকশূল’, ‘অভিনয়’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ছিলেন নজরুল। ‘চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে নির্মিত হলেও সেটার জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন তিনি।

কবির সাহিত্যকর্ম

কাজী নজরুল ইসলামের রচনার যে বিষয়টি আমার হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছিল তা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য মমতা দায়িত্ববোধ। সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের নির্যাতিত গণমানুষের বৈপ্লবিক চেতনার সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন। শিল্পের অন্য শিক্ষা কাজী নজরুল ইসলাম একথা বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। এ কারণে অন্যান্য সাহিত্যিক-কবিদের মতো তিনি সরকার ও সমাজ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে সাহিত্য রচনা করেন নি। তাঁর বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি রাজনৈতিক নেতার মতোই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, জেল খেটেছেন। তিনি উদ্ধৃত কণ্ঠে গেয়েছেন-

“কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট রক্ত জমাট শিকলপূজার পাষাণ বেদী।”

অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, সর্বহারা, ভাঙার গান প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে নজরুল সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। আবার কখনো নিদারুণ ব্যথার অভিশাপ দিয়েছেন এভাবে-

“প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে যায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ।"

তিনি ছোট্ট অবোধ নিষ্পাপ শিশুদের জন্য যেমন রচনা করেছেন রসালো ছড়া-কবিতা-গান তেমনি বড়দের জন্যও রচনা করেছেন অনেক গল্প-উপন্যাস। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি সংগীতকেও তিনি গ্রামবাংলার মানুষের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। তিনি প্রেম-ভালোবাসার গান যেমন গেয়েছেন, তেমনি বিদ্রোহের সুরও ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো তাঁকে সমসাময়িকতার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে। তাঁর কাব্যে প্রেম প্রতিমা রূপ ধরে এসেছে। তিনি বলেছেন-

“মোর প্রিয়া হবে এস রাণী
দেব খোপায় তারার ফুল”

কবি সাম্যবাদী

নজরুলের সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণাও আমাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” এটা ছিল নজরুলের সাহিত্য ও জীবন-চেতনার পরম সত্য। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ বলে কিছু নেই। রাজক্ষমতা হারিয়ে ভারতের মুসলমানরা যখন হতাশাগ্রস্ত ও দিশেহারা তখন তাঁর ইসলামী ভাবাবেগসমৃদ্ধ কবিতা-গান-গজল তাদের বিশেষভাবে উজ্জীবিত করেছিল।

অসুস্থতা

কাজী নজরুল ইসলাম নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি বেতারে কাজ করেছিলেন । সেই সময় নজরুল ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থ তার বাক শিক্ত হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থ সম্বন্ধে জানা যায় ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে। এর পর তাকে হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করা হয়েছিল। তিনার নিউরো সার্জারি করার জন্য ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হয়ানি কারণ সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হচ্ছিল। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তারা বুঝতে পারলেন নজরুল এমন এক দুরারোগ্য রোগে ভুগছেন যা আরোগ্য লাভ করা ছিল প্রায় অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরনঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সঙ্কিচুত হয়ে যায়।এরপর ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর কবি রোম থেকে দেশে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

বাংলাদেশে আগমন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৭১ সালে। কবি কাজী নজরুলকে ১৯৭২ সালে ভারত থেকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে আনা হয়। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশে কাটে। আর ১৯৭৬ সালে নজরুলকে বাংলাদের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। কবি নজরুল ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ১৯৭৮ সালে মৃত্যবরণ করে। নজরুলের শেষে জীবনের দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে।

কবির প্রয়াণ

যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হয়নি। কবি নজরুল ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ১৯৭৮ সালে মৃত্যবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ অবনতি হতে শুরু করলে নজরুলকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই খানে তার বাকি জীবন কাটে। আমাদরে প্রয়ি কবি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট তিনি ৭৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় । আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

সম্মাননা

বাংলাদেশ

বাংলাদেশে রাষ্ট্রেয় জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। বাংলাদেশর রণসঙ্গীত গৃহীত আছে নজরুলে রচিত “চল্ চল্ চল্ , ঊর্ধগগনে বাজে মাদল”। প্রতি বছর বাংলাদেশে নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবাষিকী পালন করা হয়। কাজী নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ২০০৫ সালে ত্রিশালে কবি কাজী নজরুল  ইসলাম বিশ্বাবদ্যালয় নাম প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৪ সালে ৯ ডিসেম্বর বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সস্মানসূচক ‍ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। তাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক একুশে পদকে ভূষিত করা হয় ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।

ভারত

২০১২ সালে চুরুলিয়ার কাছে আসানসোল মহানগরে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং পশ্চিমবঙ্গ চুরুলিয়ায় “ নজরুল অ্যাকাডেমি” নামে বেসরকারি নজরুল চর্চা কেন্দ্র আছে। কাজী নজরুলকে ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ভারতের তৃতীয় সবোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ ভূূষিত করা হয় ১৯৬০ সালে। কলকাতায় কাজী নজরুলের নামে আন্তর্জাতিব বিমানবন্দরি, সড়করে নাম কাজী নজরুল ইসলাম সরণি, মেট্রো স্টেশনটি নাম কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন রাখা হয়েছে।

লেখক ও ব্যক্তিত্ব হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে আহরিত জ্ঞান ও বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরবি-ফারসি-হিন্দি-উর্দু-সংস্কৃতের শব্দাবলি নজরুলের সাহিত্যকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাষর করেছে। শিল্পের বা জনপ্রিয়তার বিচারে নজরুলের সাহিত্য কতখানি শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে, সে বিচার করবেন বিদগ্ধজনেরা। তবে আমার কাছে নজরুল সবচেয়ে প্রিয় কবি, লেখক ও ব্যক্তিত্ব।

উপসংহার

নজরুলের আদর্শ ও যৌবন ধর্ম আজ আমাদের চলার পথের পাথেয়। তাঁর সাম্য চেতনা এবং মানবপ্রেম আজকের হানাহানিপ্রবণ পৃথিবীতে বড়ই প্রয়োজন। তাই নজরুল সাহিত্যের শিল্পমূল্যের চাইতে সামাজিক মূল্যও কম নয়। এ সমস্ত বহুমুখী গুণের অপূর্ব সমাবেশের জন্যেই তিনি আমার প্রিয় কবি। তাই তাঁর জীবনাদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠা করাই আমার একান্ত ব্রত।


বাংলা প্রবন্ধ রচনা তালিকা


সবগুলো #

এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url