বাংলা রচনাঃ একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা | একটি বর্ষণমুখর রাত রচনা | class 6 7 8 9 10
একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা রচনা |
একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা
➤ { বাংলা রচনাঃ একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা | একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা পয়েন্ট| একটি বর্ষণমুখর রাত রচনা |একটি বর্ষণমুখর দিন রচনা class 6 7 8 9 10 JSC SSC HSC ekti borshonmukhor shondha rochona }
ভূমিকা
দুরন্ত গ্রীষ্মের অসহ্য দাবদাহের অবসান ঘটাতে ধরাধামে আগমন ঘটে মোহময়ী বর্ষাকালের। বর্ষাকাল তার অবিরাম অবিশ্রান্ত ধারায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ফুটিফাটা বিশ্বসংসারকে সিক্ত করে। বর্ষার করুণাধারায় ভূমি হয় শীতল, প্রকৃতি নতুন প্রাণ ফিরে পায়। জ্যৈষ্ঠ মাসের অবসানে শ্রাবণ মাসের সূচনালগ্নে আকাশ কালো করে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা যখন ভূমিতে নেমে আসে, তখন দীর্ঘ দুই মাস ব্যাপী শুষ্ক তৃষ্ণার্ত পৃথিবী বুভুক্ষুর মতন পান করে মেঘেদের দেওয়া প্রানসুধা।
একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অনুভূতি ও আবেগ শুধুমাত্র অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা দুবুহ। এমন সন্ধ্যা উপভোগ্য, সুন্দর। বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় তন্ময় হয়ে কবিগুরু উচ্চারণ করেছেন-
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন মেঘভরে বাদল ঝর ঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।'
বরবরযার ঝর ঝর সারাদিন করছে। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। বিরাম নেই তিলমাত্র। আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। মেঘের পরে মেঘ। কাজল কালো মেঘের রাশি পূবাল বায়ে সওয়ার হয়ে ছুটে চলেছে। তার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বিকেল পাঁচটার দিকে বৃষ্টি একটু কমে এলেও আকাশে মেঘের কমতি নেই। ঘণ্টাখানেক বিরতির পর মেঘ আরও ঘনিয়ে এল। যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পাখিরা সব ফিরে গেল আপন আপন কুলায়। গৃহপালিত হাঁস-মুরগি সব উঠে পড়ল ঘরে ঘরে। আবার অকাশ ভেঙে মুষলধারে নেমে এল বৃষ্টি। দিনের পালা সাজা না হতেই কালো পাখা মেলে ধরাধামকে গ্রাস করল সন্ধ্যা। ঘনিয়ে এল আঁধার। আমার মনে এল-
“রজনী শাওন ঘন
ঘন দেয়া গরজ
রিনি ঝিমি শব্দে বরিষে।”
গৃহকোণ ভরে গেল নিকষ কালো আঁধারে। নিস্তব্ধ চারদিক। শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়ে অনুরণন তুলছে অবিরান বারিধারার ঝম ঝম শব্দ। ছোট বোনটি হ্যারিকেনটা ছেলে রেখে গেল পড়ার টেবিলে। আমি তখনও চেয়ারটায় বসে আছি খোলা বাতায়ন পাশে। জানালার গ্রিল ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে বাতাস। ভেজা আর ঠান্ডা। চাদরটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিবিষ্টচিত্তে চেয়ে থাকি বর্ষণসিক্ত বাইরে। বাইরে তখন সূচিতেনা অধারের রাজত্ব। সব একাকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের মৃদু ঝিলিক। তারই মাঝে চোখে পড়ছে বাইরের বর্ষণসিক্ত গাছগুলো যেন ডিজে চুপসে জবুথবু হয়ে রয়েছে। একঘেয়ে বর্ষণের সুর ছাড়া সবই যেন নীরব নিথর। চরম একাকীত্ব গ্রাস করল আমায়। এ মুহূর্তে মনে হতে লাগল আমি যেন বড় একা। এক মহা তেপান্তরে জনশূন্য কব্দে একা অন্তরীণ। মনে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার চরণদ্বয়-
"একলা বলে ঘরের কোণে কী যে ভাবি আপন মনে,
সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে।"
নিষ্প্রান্ত উল্কার মতো আমার মন-বলাকা কোথায় ছুটে চলেছিস জানি না। হঠাৎ ঘটল ছন্দপতন। ছোট বোনটির কণ্ঠস্বর- 'ভাইয়া তোর মুড়ি।' বাস্তবে ফিরে এলান। এ বৃষ্টিভেজা দিনে মাখানো মুড়ি সত্যি খুব মুখরোচক। পরম অগ্রহে বোনটির হাত থেকে টেনে নিলাম মুড়ির বাটি। তাকে প্রাণ খুলে ধন্যবাদ নিলাম। বোনটি মৃদু হেসে চলে গেল। জানি, খানিক পরেই না পাঠিয়ে দেবেন ধূমায়িত মুড়ি খেতে খেতে আবার আনমনা হয়ে পড়লাম। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কবিতা-
'বরষার ঝর ঝর
মাঠ-ঘাট থৈ থৈ
সারাদিন ঝরছে
খাল-বিল ভরছে।'
গভীর আঁধারে ছেয়ে গেছে দিক-দিগন্ত। কালো নেকাবে মুখ ঢেকেছে প্রকৃতি। এমন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় শ্রীবনের হাসি-কান্না ও আনন্দ-
বেদনার টুকরো টুকরো বহু স্মৃতি হৃদয়পটে উঠছে ভাষর হয়ে। প্রাণের পেয়ালা সে আবেগে হয়ে উঠেছে আদ্ভুত, ভাষাহীন ভাব। বাণীহারা অনুভূতি হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিচ্ছে অবিরত। উদাস মনে গাইতে ইচ্ছে করছে বিদ্যাপতির বর্ষার সেই গান-
'এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।'
বর্ষণমুখর সন্ধ্যার নিকষ কালো আঁধারে আসমান-জমিন সব একাকার। প্রকৃতির সবকিছু মিলে গড়ে তুলেছে এক কল্পনার রঙিন জগৎ। কল্পনার সে রাজ্যে মন শুধু পাড়ি জমাতে চায় আকাশ সায়রে ভাসমান মেঘের ভেলায় চড়ে।
কল্পনার রে জাল বুন বুনতে বুনতে কখন যেন হারিয়ে গেছি আত্মবিস্মৃতির গভীরে। প্রকৃতির মাঝে আমার ব্যক্তিসত্তা একাকার হয়ে গেছে। হঠাৎ মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে এল। মা খেতে ডেকেছেন। সময়ের ঘণ্টাধ্বনি জানিয়ে দিল রাত দশটা। তখনো বৃষ্টি ঝরে চলেছে অবিরাম। কিন্তু বর্ষণমুখর সন্ধ্যার সে স্বপ্নিল আবেশময় পরিবেশ অনেক আগেই অনুপ্রবেশ করেছে রাতের সীমায়।
সন্ধ্যাবেলার মায়া
গোধূলির পর সন্ধ্যার সময়টি আমাদের সকলের কাছে এক পরম মায়া জড়ানো। আকাশ থেকে এই সময়ে দিনের আলো একেবারে মুছে যায় না, প্রকৃতির চারিপাশে তখনও চেপে বসে না ঘন অন্ধকার। পশ্চিমাকাশে একটু একটু করে ফুটে উঠতে শুরু করে রাত্রির নিভৃত চন্দ্রমা, আকাশের বুকে মিটমিট করে দেখা দিতে থাকে অগণিত নক্ষত্ররাজি।পাখিকুল এই সময়ে ফিরে আসতে থাকে নিজেদের বাসার দিকে, মানুষও দিনের সকল কাজের অবসানে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শরীরে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়ির অন্দরমহলে গৃহবধূর সন্ধ্যে হয় পবিত্র আরাধনার মধ্যে দিয়ে। গৃহস্থের ঘরে ঘরে শোনা যায় মধুর শঙ্খধ্বনি, পরিবেশ ভরে ওঠে নানা ধুপ ধুনোর সুগন্ধে। গোধূলিকালে মনে যে বিষণ্ণতা ও প্রশান্তির দোলাচলে টালমাটাল দেখা দেয়, সন্ধ্যেবেলা এইভাবে পবিত্র পরিবেশের মধ্যে দিয়ে তা পরিণতি পায় সম্পূর্ণতায়।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শুরু
আজ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও নীল আকাশের চিহ্ন মাত্র নেই। অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের চানি। সমস্ত দিনে সূর্যের মুখ একবারও দেখা গেল না এবং কখন যে সূর্য অস্ত গেল তাও বোঝা গেল না। আস্তে আস্তে চারদিক ঘন আঁধারে ঢেকে গেল।
প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যা নেমে আসার আগেই যেন আঁধার নেমে এল। এই দুর্যোগের মধ্যে কেউ বেরোয়নি। সমস্ত পথঘাট ফাঁকা। নির্জন পথে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর গাছের পাতার ওপর বৃষ্টিপাতের অবিরাম শব্দ এক অপূর্ব ছন্দের সৃষ্টি করছে। আমি কবি না হলেও আমার মনেও কবিত্ব জেগে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার ওপর কবিতা মনে পড়ে-
"এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরিষ
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।"
জানালার পাশে বসে অবিরাম বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনছি। সন্ধ্যার পূর্বেই পাখিরা তাদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সমস্ত দিনের অবিশ্রান্ত বর্ষণে প্রকৃতি এখন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। নির্জন পথে দূরে হঠাৎ গরুর গাড়ির চাকার আর্তনাদ শোনা গেল। রাস্তাঘাট জনশূন্য। তবুও তাদের খুব প্রয়োজনে তাদের কেউ কেউ ছাতা মাথায় বের হয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করছেন। এমন দিনেও চিনাবাদামওয়ালা, ঝাল মুড়িওয়ালা বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে চলেছে। বৃষ্টি মুখর সন্ধ্যায় বাদাম ভাজা খেতে খেতে শুনতে পাচ্ছি ব্যাঙের একটানা চিৎকার। আর জোনাকির মিটিমিটি আলো আঁধারে অপরূপ দেখাচ্ছে।
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শেষে
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শেষে পরিবেশ যে নির্জন হয়ে গিয়েছে। মনে হয় যে কেউ আর এখানে বসাবাস করে না। সবাই যেন কোথায় চলে গিয়েছে। অবিশ্রন্ত বৃষ্টি যখন শেষে হলো, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল। তখনও যে বিদ্যুৎ এর আলো আসেনি। বাড়ির চারপাশে বর্ষরা পানি যেনো থৈ থৈ করছে মনে হচ্ছে বাড়ির পাশ দিয়ে নদীর ঢেউ খাচ্ছে। আমি বাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বারিয়ে দেখলাম অনেক ধরণের ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর ভিজে মাটির গন্ধ সমগ্র পরিবেশকে মাতাল করে রেখেছে। এমন দিনে কোন কাজেই মন বসে না। বসে বসে শুধু ভাবতে ভাল লাগে। দূরে কোথাও রেডিওতে রবীন্দ্রনাথের গান শোন যাচ্ছে "মন মোর মেঘের সঙ্গীতে উড়ে চলে দিক দিগন্ত পানে।" আমরা দু'ভাই কয়েকটি বর্ষার কবিতা আবৃত্তি করলাম, যদিও সবগুলি কবিতার পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারলাম মিনা না তবুও ভাল লাগলো।
সন্ধ্যার এই সৌন্দর্য মাধুর্যের সন্ধান একবার যে পেয়েছে তার পক্ষে একে ছেড়ে কাজে মন বসান খুবই কঠিন ব্যাপার। "কোন কাজে নাহি বসে মন" কেমন এক তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা সমস্ত শরীরকে অবশ করে দেয়। সন্ধ্যার বর্ষার হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে ঘুম এসে যায়। অনেক কষ্টে মনের আলস্য ঝেড়ে বই খুলে পড়তে বসলাম। কিন্তু পড়ায় কিছুতেই যেন মন বসতে চায় না, তবু পড়তে হবেন বাইরে তখনো বাতাসের দাপাদাপি, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, বাঁশবনের অদ্ভুত শব্দ, ব্যাঙের ঘ্যানর ঘ্যানর ডাক, জোনাকীর আলো আর সর্বোপরি বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ আমাকে বারবার আনমনা করে দিতে লাগলো। বই পড়তে পড়তে বর্ষার দিন কেটে গেল।
উপসংহার
আমি মি কবি নই, অনুভবের মেঘমাল্লা নিয়ে আমার খেলা নয়। তা সত্ত্বেও বর্ষণমুখর এক সন্ধ্যায় আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম এক কল্পলোকে। বর্ষণমুখর সন্ধ্যার কোনো তুলনা হয় না। হৃদয় দিয়ে এ বর্ষণমুখর সন্ধ্যার সবকিছু উপভোগ করা যায়, মনের দুয়ার খুলে যায়- নেচে ওঠে হৃদয়। কবির ভাষায়-
"রজনী শাওন ঘন ঘন দেয়া গরজন
রিমিঝিমি শরদে বরিখে।
পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চির অঙ্গে
নিদ নাই মনের হরষে।"
এই রকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে যুক্ত থাকুন। এর পাশাপাশি গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন।